নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাত লাখের মতো সদস্য, সাত লাখের মতো ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, সাংবাদিক-পর্যবেক্ষক মিলিয়ে ১৫ লাখ লোক নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন।

নির্বাচন নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, আনসার এবং সশস্ত্র বাহিনী সম্মিলিতভাবে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আমাদের কেন্দ্রভিত্তিক নিরাপত্তা থাকবে, মোবাইল পেট্রল থাকবে, স্ট্রাইকিং রিজার্ভ থাকবে।

তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মধ্যে ইলেকশন কমিশন, রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় এবং ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘিরে নিশ্ছিদ্র এবং সুদৃঢ় নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। এখন থেকে শুরু করে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর নিরাপত্তার চাদরে আবৃত থাকবে। প্রস্তুত থাকবে আমাদের বোম ডিস্পোজাল টিম, সোয়াট ও কে-৯ ইউনিট।

বিষয়টি নিয়ে র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ বলেন, ৩০ তারিখ শান্তিপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠিত করতে ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী র‌্যাব মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবে। আমরা হেলিকপ্টার ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছি। নিজেদের ২টি এবং সেনাবাহিনীর ২টি হেলিকপ্টার সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকবে। বিশেষ প্রশিক্ষিত একটি স্পেশাল ফোর্স ঢাকায় প্রস্তুত থাকবে। দেশের যেকোনো প্রান্তে কোনো গোষ্ঠী সহিংসতার দুঃসাহস দেখালে দ্রুততম সময়ে স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের পাঠানো হবে।

একাদশ সংসদ নির্বাচন ২০১৮। ভোটগ্রহণ চলবে রবিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। এক প্রার্থীর মৃত্যুতে ভোট হবে ২৯৯ আসনে। ২৭ জানুয়ারি ভোটের তারিখ নির্ধারণ করেছে ইসি ওই আসনটিতে। ৩০ তারিখে ভোট হবে না গাইবান্ধা-৩ আসনে।

এবার ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৬ হাজার ৮২৩। তার মধ্যে পাঁচ কোটি ২৩ লাখ ৭১ হাজার ৬২০ পুরুষ। আর পাঁচ কোটি ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ২০৩ জন নারী। ৪০ হাজার ৫১ ভোট কেন্দ্রের দুই লাখ পাঁচ হাজার ৬৯১ ভোটকক্ষে হবে ভোটগ্রহণ।

এবার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ হবে ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, চট্টগ্রাম-৯, রংপুর-৩, খুলনা-২ এবং সাতক্ষীরা-২ আসনে। আর ২৯৩ আসনে ভোট হবে সনাতন পদ্ধতিতে ব্যালট পেপার ব্যবহার করে।

ভোট গ্রহণ শেষে কেন্দ্রে কেন্দ্রে গণনা শেষে প্রিসাইডিং অফিসাররা লিখিত ফল রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠাবেন। রিটার্নিং অফিসাররা তা ইসিতে পাঠাবেন। ঢাকায় নির্বাচন ভবনের ফোয়ারা প্রাঙ্গণে বিশেষ মঞ্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করা হবে।

এবার নির্বাচনী মোট প্রার্থী রয়েছে ১৮৬১ জন। এক হাজার ৭৩৩ জন দেশের ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী। আর বাকি ১২৮ জন স্বতন্ত্র।

দলভিত্তিক প্রার্থীতে আওয়ামী লীগ ২৬১ (নৌকা ২৭৪), বিএনপি ২৭২ (ধানের শীষ ২৯৭), গণতন্ত্রী পার্টি ৬, ন্যাপ ৯, জাতীয় পার্টি ১৭৬ (মহাজোট ২৫), এলডিপি ৮ (ধানের শীষ ৪), জেপি ১১ (মহাজোট ২), সাম্যবাদী দল ২, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ৯ (ধানের শীষ ৪), সিপিবি ৭৪, বিকল্পধারা ২৫ (নৌকা ৩), ওয়ার্কার্স পার্টি ৮ (নৌকা ৫), জাসদ ১২ (নৌকা ৩), জেএসডি ১৯ (ধানের শীষ ৪), জাকের পার্টি ৯০, বাসদ ৪৫, বিজেপি ৩ (ধানের শীষ ১), তরিকত ফেডারেশন ১৭ (নৌকা ১), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ২৩, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ ৪৮, এনপিপি ৭৯, জমিয়াতে উলামায়ে ইসলাম ৮ (ধানের শীষ ৩), গণফোরাম ২৭ (ধানের শীষ ৭), গণফ্রন্ট ১৩, পিডিপি ১৪, বাংলাদেশ ন্যাপ ৩।

এছাড়া, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ১১, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ১৮, কল্যাণ পার্টি ২ (ধানের শীষ ১), ইসলামী ঐক্যজোট ২৪, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ৫, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ২৯৮, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ২৫, জাগপা ৪, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ২৮, খেলাফত মজলিস ১২ (ধানের শীষ ২), বিএমএল ১, মুক্তিজোট ২, বিএনএফ ৫৭ জন।

দেশে প্রধাণ দুটি জোটের মধ্যে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক ১৬টি দল। আর জাতীয় পার্টির নিজেদের লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে। বিএনপিসহ তাদের জোট শরিক আটটি দল ধানের শীষে ভোট করছে। নিবন্ধিত দলের বাইরে জামায়াত ও নাগরিক ঐক্যের প্রার্থীরা ধানের শীষ প্রতীকে লড়ছেন।

অন্যদিকে, বামদল গুলো মধ্যে গণতান্ত্রিক বাম জোটের দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কাস্তে, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) মই এবং বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতীক কোদাল।

ইসলমী দলগুলো মধ্যে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ হাতপাখা, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন বটগাছ, ইসলামী ঐক্যজোট মিনার, জাকের পার্টি গোলাপফুল

এছাড়া, বিএনএফ টেলিভিশন, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল বাঘ প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে রয়েছে।

বিধিনিষেধ: গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, ২৮ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত কোনো ধরনের সভা, সমাবেশ, মিছিল বা শোভাযাত্রা করা যাবে না। ভোটের দিন ২৪ ঘণ্টা নির্বাচনী এলাকায় ট্যাক্সি ক্যাব, বেবিট্যাক্সি/অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো, লঞ্চ, ইজিবাইক, ইঞ্জিনবোট ও স্পিডবোট চলাচলের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকবে শনি থেকে সোম তিন দিন। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী, সরকারি গাড়ি, সেবা সংস্থা যেমন-ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদপত্রবাহী গাড়ি এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে।

ইসি জানিয়েছে, কেন্দ্রের ভেতরে কেবল প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং কেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের ইনচার্জ মোবাইল ব্যবহার করতে পারবেন। ভোটাররা কোনোভাবেই বুথ বা কেন্দ্রের ভেতরে ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। ভোটাররা কেউ মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রে গেলেও তা বন্ধ রেখে যেতে হবে। ভোট দিতে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন পড়বে না। তবে ভোটারের এনআইডি নম্বর, ভোটার নম্বর বা স্মার্টকার্ড সঙ্গে থাকলে ভোটার তালিকা থেকে নাম বের করতে সুবিধা হবে।

ইভিএমে ভোট: এবার ৬টি আসনে ইভিএমে ভোট হবে। ৮৪৫টি কেন্দ্রের পাঁচ হাজার ৪৫টি ভোটকক্ষে মোট ২১ লাখ ২৪ হাজার ৫৫৪ জন ভোটার রয়েছেন। এভিএমের আওতায় রয়েছে মোট ৪৮ জন প্রার্থী। এ থেকে নির্বাচন হবেন ৬ জন।

নির্বাচনী দায়িত্বে দেশের মোট ৬৬ রিটার্নিং অফিসার জেলা এবং ৫৮২ সহকারী রিটার্নিং অফিসার উপজেলা পর্যায়ে সার্বিক তত্ত্বাবাধনে দায়িত্ব পালন করবেন। ৪০ হাজার ১৮৩ জন প্রিসাইডিং অফিসার থাকবেন কেন্দ্রের দায়িত্বে। আর তাদের অধীনে দুই লাখ সাত হাজার ৩১২ সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬২৪ জন পোলিং অফিসার ভোটগ্রহণের মূল কাজটি করবেন।

নির্বাচনী মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্বে থাকছে বিভিন্ন বাহিনীর ছয় লাখ আট হাজার সদস্য। এর মধ্যে এক লাখ ২১ হাজার পুলিশ; চার লাখ ৪৬ হাজার আনসার এবং ৪১ হাজার গ্রাম পুলিশ রয়েছেন। ৬০০ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) র‌্যাব এবং ৯৮৩ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) বিজিবি সদস্যও রয়েছেন ভোটের মাঠে। ৩৮৯ উপজেলায় ৪১৪ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) সেনা সদস্য, ১৮ উপজেলায় নৌবাহিনীর ৪৮ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) এবং ১২ উপজেলায় ৪২ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) কোস্টগার্ড ভোটের দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়া, সারা দেশে এক হাজার ৩২৮ নির্বাহী হাকিম এবং ৬৪০ বিচারিক হাকিম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে থাকবেন। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ১২২টি নির্বাচনী তদন্ত কমিটির ২৪৪ সদস্য থাকবেন ভোটের মাঠে।

এবারের নির্বাচনে ৮১টি দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার ২৫ হাজার ৯০০ প্রতিনিধি, ৩৮ (ফেমবোসা, এএইএ, ওআইসি ও কমনওয়েল্থ থেকে আমন্ত্রিত) বিদেশি পর্যবেক্ষক, বিভিন্ন বিদেশি মিশনের ৬৪ কর্মকর্তা এবং দূতাবাস ও বিদেশি সংস্থায় কর্মরত ৬১ বাংলাদেশি এবার ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন।

নির্বাচন পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলায় ৭০০ কোটি টাকার খাতওয়ারি বরাদ্দ অনুমোদন করেছে ইসি। এর দুই-তৃতীয়াংশই যাবে নিরাপত্তা খাতে।

সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয় এ নির্বাচন। বিএনপিসহ অধিকাংশ নিবন্ধিত দল এ নির্বাচন বর্জন করেছিল।

সেই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে একক প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বাকি ১৪৭টি আসনে ৪০.০৪ শতাংশ ভোট পড়ে।আওয়ামী লীগ ২৩৪ আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। আর জাতীয় পার্টি ৩৪, ওয়ার্কার্স পার্টি ছয়, তরিকত ফেডারেশন দুই, জাতীয় পার্টি-জেপি দুই, বিএনএফ এক ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬টি আসন পায়।