সৌদি ফেরত নারী কর্মীদের কান্না
গত বছরের আগস্টে সৌদি আরবে বসবাসকারী এক বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওটি নিয়ে তখন অনেক সংবাদমাধ্যম খবর পরিবেশন করে এবং শেষ পর্যন্ত নির্যাতনের সত্যতাও পাওয়া যায়।
নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরার পথে রিয়াদ বিমানবন্দরে উড়োজাহাজে বসে এক আরবকে ওই নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছিলেন সেই নারী, যা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছেড়ে দেন সেই ব্যক্তি। ভিডিওতে ওই নারীর এক হাতে ক্ষতচিহ্ন, আরেক হাতে গোটা গোটা ফোস্কা দেখা যায়।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, সৌদি আরবে কাজে আসার পর প্রতিদিন আমাকে ছয় থেকে সাতবার গরম কিছু দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়া হত। সেই থেকেই হাতে ফোস্কা হয়ে গেছে। ভিসা ও পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, নির্যাতিত ওই বাংলাদেশি নারীর বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। তিনি গত বছরের ২২ জানুয়ারি সৌদি আরবে যান। সৌদিতে তার নিয়োগকর্তা ছিলেন আজিজা নাশহাত মোহাম্মদ আলী কাকা।
শনিবার (১৯ মে) রাত ৯টায় এয়ার অ্যারাবিয়ার একটি ফ্লাইটে করে বাংলাদেশে ফিরে আসা ৬৬ জন নারীর একজন হলেন সালমা (ছদ্ম নাম)। তিনি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের জানান, সৌদি আরবে প্রতিনিয়ত নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সেখানে তাদের আটকে রেখে ইলেকট্রিক শক দেয়ার পাশাপাশি রড গরম করে ছ্যাঁকা পর্যন্ত দেওয়া হয়।
সালমা বলেন, আমার পাসপোর্ট রেখে দিয়েছে মালিক। আমি সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে আসি। দূতাবাস থেকে আমাকে আউটপাস দিয়ে দেশে পাঠায়। আমি এক বছর কাজ করেছি। কিন্তু বেতন দিয়েছে তিন মাসের। তার ওপর আমাকে ওরা গালাগালি করতো, খেতেও দিত না ঠিকমতো।
লাবনী (ছদ্ম নাম) নামে আরেকজন জানান, সৌদি আরব যাওয়ার জন্য মিরাজ নামের এক দালালকে ৬০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। সে আমাকে বলেছিল, সৌদি আরব অনেক ভালো জায়গা। কিন্তু যাওয়ার পর প্রথমে আমাকে এক মালিকের কাছে বিক্রি করা হয়। মালিকের অত্যাচারে ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। তখন আমারে ধরে একটা কোম্পানির মাধ্যমে ছয় লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়।
আমার মতো আরও কয়েকশ মেয়ে আছে সেখানে। তাদের দিয়ে জোর করে দেহব্যবসা করানো হয়। আমি একবার সুযোগ বুঝে আমার স্বামীকে ফোন করে সব বলি। তারপর আমাকে সৌদি আরবে বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়।
‘ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম’-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রতি মাসে গড়ে ২০০ করে নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। সৌদি আরবের রিয়াদ এবং জেদ্দায় সেফ হোমগুলোতে গড়ে ২০০ জন করে নারী শ্রমিক আশ্রয় নিয়েছেন। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান ডয়চে ভেলেকে জানান, গত তিন বছরে কমপক্ষে পাঁচ হাজার নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। এই নারীদের একটি বড় অংশ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার।
তিনি বলেন, ২০১১ সালে ফিলিপাইন্স ও শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশ সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়। তার প্রধান কারণ ছিল নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন। ফিলিপাইন্সের একটি প্রতিনিধি দল সৌদি আরবে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে নির্যাতনের প্রমাণ পেয়ে সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
২০০৮ সাল থেকে সৌদি শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য বন্ধ ছিল। সে কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠাতে রাজি হয়। কিন্তু বাংলাদেশ তখন ভাবেনি যে অন্যরা যখন সৌদি আরবে নির্যাতনের কারণে নারী শ্রমিক পঠানো বন্ধ করেছে, আমরা কেন পাঠাচ্ছি। নির্যাতন যাতে না হয় সেরকম কোনো পদক্ষেপের কথাও বলেনি বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, সম্প্রতি যারা ফিরে এসেছেন, তাদের মধ্যে যৌন নির্যাতনের কারণে অন্তঃসত্ত্বা নারীও আছেন। এ ছাড়া শারীরিক নির্যাতরে শিকার হয়েছেন অনেকেই। আরেকজন মেয়েকে আমরা পেয়েছি যে সৌদি আরবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন। এখন তার বাবা তাকে আর পরিবারে ফেরত নিতে রাজি নন। আমরা বাধ্য হয়ে তাকে শেল্টার হোমে পাঠিয়েছি।
২০১৫ সাল থেকে ২ লাখেরও বেশি নারী শ্রমিক পাঠানো হয় সৌদি আরবে। তাদের মধ্যে নির্যাতনসহ নানা করণে ৪০ হাজারের মতো নারী শ্রমিক সেখান থেকে ফেরত এসেছেন।
সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর সারোয়ার আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, রিয়াদ এবং জেদ্দায় আমাদের দুটি ‘সেফ হোম’ আছে। যেসব নারী কর্মী বিপদে পড়েন, তাদের আমরা সেখানে আশ্রয় দেই। এরপর তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি। দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। এখানো সেখানে ৪০ জনের মতো নারী কর্মী আছেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা নির্যাতনের অভিযোগ পাই। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও আছে। আইনগত প্রতিকার পেতে হলে এখানকার থানায় মামলা করতে হয়। তবে সেই মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সেই শ্রমিককে এখানে থাকতে হয়। কিন্তু প্রায় কেউ-ই শেষ পর্যন্ত মামলা করতে চান না। থাকতেও চান না। তবে শুধু নির্যাতন না, অনেকে এখানে অ্যাডজাস্ট করতে পারেন না। ভাষাগত সমস্যা হয়। আবার অনেকের কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এ সব কারণেও ফেরত যান।
সারোয়ার আলমের কথায়, আমরা তারপরও এই সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছি। কথা বলছি। কিন্তু জনবল কম। আমাকে একা ৫৩টি জেলা দেখতে হয়।
তিনি জানান, সৌদি আরবে আইন বেশ কড়া। অর্থাৎ ঘটনা প্রমাণ করতে পারলে প্রতিকার পাওয়া যায়। আমরা ২-৩টি ঘটনায় থানা-পুলিশ পর্যন্ত যেতে পেরেছি। অন্যগুলোয় পারিনি। কারণ কেউ থেকে মামলা চালাতে চায় না। তবে চাইলে আমরা সহযোগিতা করি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে যেসব নারী কর্মী সৌদি আরব যান, তাদের কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না। তাই কোনো খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তারা মামলা না করে নিজের পাওনা নিয়ে দেশে ফেরত আসতে চান। দেশে ফেরত আসলে তাকে লিখিত দিতে হয় যে নিয়োগ কর্তা তার সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ বা শর্ত ভঙ্গ করেনি। ফলে আইনগত প্রতিকার পাওয়া কঠিন হয়। কিন্তু সরকার চাইলে ওই নিয়োগ কর্তাদের চিহ্নিত করে ‘ব্ল্যাক লিস্টেড’ করতে পারে।
তিনি বলেন, আমরা এখন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছি কীভাবে সৌদি আরবে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানোর পদ্ধতিতেই গলদ আছে। এমওইউ স্বাক্ষরের মাধ্যমে সেখানে নারী শ্রমিক পাঠানো হয়। ফলে কোনো সরকারেরই আইনগতভাবে দায় নাই। দায় হলো শুধুমাত্র নিয়োগ কর্তার। যদি দুই সরকারের মধ্যে চুক্তির অধীনে এই শ্রমিকদের পাঠানো হতো, তাহলে আইনি প্রতিকার পাওয়া যেত। তাই এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করা দরকার। তা না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে।
সূত্র: ডয়চে ভেলে
- কমলো সয়াবিন তেলের দাম, যা তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন
- স্বর্ণের ভরি আজ হঠাৎ কত হলো জানেন
- মালয়েশিয়ায় ৫ শতাধিক বিদেশি গ্রেপ্তার, বেশির ভাগই বাংলাদেশি
- নাটকীয়ভাবে অবিশ্বাস্য সুখবর পেলো বাংলাদেশ
- নাসুমকে চড় মারার চাঞ্চল্যকর অভিযোগের জবাবে মুখ খুললেন হাথুরু-সাথীরা
- বিদেশি ফল নয়, ঘরেই লুকিয়ে আছে সমাধান এই ৫ দেশি খাবারেই পাবেন পর্যাপ্ত ভিটামিন সি
- শীর্ষে দিল্লি,২ নাম্বারে ঢাকা