আমি কবর থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়
-2.jpg&w=315&h=195)
গত বছরের জুন মাসের কথা। অস্ট্রেলিয়াতে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচে মাঠে নেমেছি আমরা। মাত্রই আমরা একটা ফ্রিকিক পেলাম। বলের সামনে দাঁড়িয়ে আমি, উইলিয়ান, সাথে আরো দুজন। আমি কিক নেয়ার জন্য দাঁড়াইনি, কিক নিবে উইলিয়ান; শুধু প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য দাঁড়ানো আর কি! হঠাত দেখতে পেলাম কেউ একজন আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সেই মানুষটা লিওনেল মেসি। ও এসে আমার চোখে চোখ রেখে বললো, “আমরা দুজন এক দলে খেলতে পারলে কেমন হয় বলো তো? তুমি বার্সেলোনায় আসতে রাজি?” এই বলে সে ঘুরে চলে গেলো, বিস্তারিত কিছুই বলল না। আমাকে ভাবার মতো কোনো সময়ই দিলো না লিও, কোনোরকমে জবাব দিলাম, “তুমি চাইলে তো অবশ্যই!
আমি সহজে ফুটবল মাঠে মনোযোগ হারাই না। কিন্তু ওই মুহূর্তে লিওর কথাগুলো আমার মাথায় ঘুরতে লাগলো কেবল। আমি শুধু ভাবছিলাম সে কি সিরিয়াস? আমাকে কেন ওর মনে ধরলো? হায় ঈশ্বর, সত্যিই কি আমি এমন সুযোগটা পেতে যাচ্ছি? তখন আমি খেলতাম চাইনিজ সুপার লীগে; গুয়াংজু এভারগ্রাণ্ডের হয়ে। বার্সেলোনার মতো দল আমার ব্যাপারে আগ্রহী হবে, তা আমি তখন পর্যন্ত কল্পনাতেও আনিনি। তাহলে কি লিও মজা করলো আমার সাথে?
আমার মনোযোগ খেলা থেকে উঠিয়ে নেয়ার জন্য? কিন্তু এটাতো শুধু একটা প্রীতি ম্যাচ, আহামরি কিছু নয়। তাহলে? খেলা শেষে আমি আমার জার্সিটি খুলে সিকিউরিটি গার্ডকে দিলাম, সে যাতে সেটি মেসির কাছে পৌঁছে দেয়। সেই গার্ড আর্জেন্টিনার ড্রেসিং রুম থেকে ফিরলো মেসির জার্সি নিয়ে, যেটা সে আমার জন্য পাঠিয়েছে! তখন একটু একটু বিশ্বাস করতে শুরু করলাম।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ট্যুর শেষে যখন চীনে ফিরলাম, এক মাসে কোনো খবরই এলো না। আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম সেদিনের কাহিনী, সুপার লীগেই বেশ উপভোগ করছিলাম। জুলাইতে যখন আমার বার্সেলোনায় যাওয়া নিয়ে গুঞ্জন শুরু হলো, তখন এবারও নড়েচড়ে বসলাম। এজেন্টকে ফোন দিয়ে বললাম, বস, উত্তেজনায় তো পাগল হয়ে যাবো। এসব কি গুজব নাকি সত্যি? সে জবাব দিলো, হয়তো সত্যি, হয়তো না! নেইমারকে টেক্সট দিয়ে সে কিছু জানে কি না জিগ্যেস করলাম।
কিন্তু তখন সে নিজের ট্রান্সফার নিয়েই বেশ চিন্তিত, তাই সেও কিছু নিশ্চিত করে বলতে পারলো না। তাই ট্রান্সফার উইন্ডোর একেবারে শেষ দিকে একদিন ভোর চারটায় যখন আমার এজেন্ট ফোন করে বলল, বার্সার সাথে সব চুক্তি সম্পন্ন; তখনও ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না! ব্রাজিল থেকে আমার বন্ধুরা এসেছিলো , তাদের নিয়েই স্পেনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
এয়ারপোর্টে যাওয়ার গাড়িতে বসে শুধু এক জনের নামই মনে মনে আওড়াতে লাগলাম, মেসি!। কিন্তু আপনাদের যদি মনে হয় পুরো ব্যাপারটিই পাগলামো তাহলে অবশ্যই আপনাদের আমার গল্পটা জানতে হবে। আমার জীবনের গল্পটাও কোনো অংশে কম আশ্চর্যের নয়।
১৯ বছর বয়সে আমি পুরোপুরি ফুটবল ছেড়ে দিলাম! সালটা ২০০৮, মেসি তখন বার্সেলোনার হয়ে ট্রেবল জিতল আর আমি আমার বাসার সোফায় বসে বসে ভাবতে থাকলাম, বাকি জীবন কি করে খাবো! মাত্রই লিথুনিয়া , পোল্যান্ড ঘুরে সাও পাওলোতে আমার বাড়িতে এসে উঠেছি। আমার ইউরোপের সেই অভিজ্ঞতা ছিলো ভয়াবহ!
লিথুনিয়ায় আমার শুরুর সময়টা খারাপ ছিলো না, ভালোই উপভোগ করছিলাম। ভিলনিয়াসের হয়ে খেলতাম, শহরটা ছিলো মুভিতে দেখানো মধ্যযুগের শহরগুলোর মতো, ব্রাজিলের সাথে মিল নেই একদম। ভাষাগত সমস্যা ছিলো, কিন্তু শান্তিতেই কাটছিলো জীবন। তারপর একদিন আমার ব্রাজিলিয়ান সতীর্থদের সাথে রাস্তায় হাঁটছিলাম, এক দল লোক এসে….. যাক সে কথা মনে আনতেও খারাপ লাগে।
শুধু এটুকুই বলবো, তারা বানরের অনুকরণ করছিলো আমাদের দেখে আর আক্রমণাত্মকভাবে অপমান করছিলো। আমি আশ্চর্য হলাম এই ভেবে, আমরা তো কারো কোনো ক্ষতি করিনি, শুধু একটা বেকারিতে যাচ্ছিলাম। ম্যচের সময় প্রতিপক্ষের সমর্থকরা আমাদের দিকে কলা আর কয়েন ছুঁড়ে মারত, ভয়াবহ অবস্থা! এসবে অতিষ্ঠ হয়ে পোল্যান্ডে পাড়ি জমালাম, সেখানেও একই পরিস্থিতি। জীবনে কখনো এরকম বর্ণবাদী আচরণের স্বীকার হইনি। ফুটবলের প্রতি আমার সব মোহ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ওই সময়টায়!
সবকিছু ছেড়েছুড়ে বাড়ি ফিরে আমার বাবা মা আর প্রাক্তন স্ত্রীকে বললাম, যথেষ্ট হয়েছে, আর না! আমি ফুটবল ছেড়ে দিয়েছি। তখন আমার প্রাক্তন আমাকে বলল, ফুটবল ছেড়ে করবে টা কি তুমি? একটা বাল্বও তো লাগাতে পারো না! আমি বললাম, ব্যাপার না শিখে নেবো। ও বলল, এমন কিছু করো না, যাতে বাবা মায়ের অসম্মান হয়। ওরা অনেক ত্যাগ করেছে তোমার জন্য। ওর কথাগুলো আমার জীবন পাল্টে দিয়েছিলো। ওর কথাগুলো ছিলো বড়ই সত্য, পাঁচ বছর বয়স থেকে আমি ফুটবল ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। এতটাই ফুটবলে মজে থাকতাম যে রাতে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারতাম না, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে খালি ভাবতাম কখন সকাল হবে আর আমি বল পায়ে নিয়ে ছুটবো। যে কোনো পরিস্থিতে আমি সব সময় মায়ের সমর্থন পেয়ে গেছি।
আমি আবার শুরু করি, একদম শুরু থেকে। ব্রাজিলের চতুর্থ বিভাগের একটি ক্লাবের হয়ে। ভাবতে পারবেন না, একেকটি ম্যাচ খেলতে আট ঘণ্টার বেশি বাস জার্নি করে ভ্যেনুতে যেতে হতো ! এক সময় আবার মনে হতে লাগলো, আমার আসলে ঘর বাড়ি বানানোর কাজ শুরু করা উচিৎ। এভাবে আর কদ্দিন? কিন্তু ধীরে ধীরে – প্রতিদিন অনুশীলন আর খেলার মাধ্যমে আমি ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাটা আবার ফিরিয়ে আনি। চতুর্থ বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগ, তারপর করিন্থিয়ানসের মতো প্রথম সারির একটা দলে সুযোগ মিলে যায়।
করিন্থয়ান্সে আমি আমার দ্বিতীয় বাবাকে খুঁজে পাই। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং প্রফেসর তিতে! তিতের কথা বলতে গেলেই আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি , কারণ ওনার সাথে আমার যোগাযোগ সাধারণ কিছু নয়। উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারেন, আমি ভালো আছি কিনা, কোথাও কোন গড়বড় আছে কি না! এজন্য আমাদের কথা বলার প্রয়োজন হয় না। ২০১১ তে করিন্থিয়ান্সের হয়ে কোপা ব্রাসিলিয়া জয়ের পর ইন্টার মিলানের মতো ক্লাব আমাকে দলে ভেড়াতে চায়।
আমি তিতেকে জানাতে ও বলল, জীবনটা তোমার। তাই সিদ্ধান্তও তোমার। আমি চাইবো যে তুমি থাকো। এখন তুমি নিজে ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। শুধুমাত্র তিতের অধীনে খেলার জন্যই আমি ইন্টারের লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই। তিতের অধীনে কোরিন্থিয়ান্সে কাটানো ৪ টি বছর ছিলো আমার জীবনের সব থেকে সোনালী অধ্যায়। এমনকি করিন্থিয়ান্স ছেড়ে যখন টটেনহামে গেলাম, দ্বিতীয় মৌসুমটা একেবারেই ভালো ছিলো না আমার জন্য। ওই সময়টাতেও তিতে আমাকে সাহস জুগিয়ে গেছেন।
স্পারসদের হয়ে আমি বেশ কম সময়ই খেলেছি কিন্তু সময়টা খুব সুখকর ছিল না। আমি প্রায় ম্যাচেই একাদশের বাইরে থাকতাম ; অবশ্যই আমার খারাপ পারফর্মেন্সের জন্য, অন্য কোন কারণ নেই। কিন্তু আমি মনে করি একজন ফুটবলারের জন্য খেলতে না পারাটা হচ্ছে অনেকটা পানির বাইরে থাকা মাছের মতো। তাই গুয়াংজু যখন আমাকে নিতে চাইলো, আমি বললাম, কেন নয়?
অন্তত সেখানে নিয়মিত ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবো! বন্ধু বান্ধব অনেকেই চায়না! বলে নাক সিটকালো। তবে আমি তাতে দমে যাইনি। দানি আলভেসের একটা কথা আমার খুব প্রিয়। ও বলেছিলো, আমরা হচ্ছি বৃষ্টির মধ্যে খেলতে থাকা বাচ্চাদের মতো! এক জায়গায় মানিয়ে নিতে না পারলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। কোথাও না কোথাও জায়গা হয়েই যাবে। গুয়াংজুর তখনকার ম্যানেজার ছিলেন লুই ফিলিপ স্কলারি। অন্তত তাঁর জন্য হলেও তো ওখানে যাওয়া যায়!
আমার মতে একজন ফুটবলার হিসেবে আপনি তখনই ভালো খেলবেন যখন আপনি আপনার খেলাটাকে চূড়ান্ত উপভোগ করবেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে কখন বল পায়ে ছুটবেন এই চিন্তায় যখন আপনার রাতে ঘুম হবে না , তখন। ঠিক আমার ছোট বেলাকার মতো। আপনি দুনিয়ার সেরা লীগে খেলুন, সমস্যা নেই কিন্তু আপনি যদি নিজের পারফর্মেন্সে সন্তুষ্ট না হোন, কি লাভ?
অনেকেই গুয়াংজুতে যাওয়ার পর আমার ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন । কিন্তু কই? এই যে আমি! আজকের পাওলিনহো। ওই খারাপ সময়টায় আমি ভাবতাম , আরে! কদিন আগেও না আমি ব্রাজিলের চতুর্থ সারির একটা দলের বাসে বসেছিলাম। কে চিনতো আমায় তখন? আমি একটা কবরের মধ্যে ছিলাম জাস্ট ! পুরো পৃথিবীর কাছে পাওলিনহো ছিলো একজন মৃত, অখ্যাত মানুষ
- কমলো সয়াবিন তেলের দাম, যা তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন
- স্বর্ণের ভরি আজ হঠাৎ কত হলো জানেন
- মালয়েশিয়ায় ৫ শতাধিক বিদেশি গ্রেপ্তার, বেশির ভাগই বাংলাদেশি
- নাটকীয়ভাবে অবিশ্বাস্য সুখবর পেলো বাংলাদেশ
- নাসুমকে চড় মারার চাঞ্চল্যকর অভিযোগের জবাবে মুখ খুললেন হাথুরু-সাথীরা
- বিদেশি ফল নয়, ঘরেই লুকিয়ে আছে সমাধান এই ৫ দেশি খাবারেই পাবেন পর্যাপ্ত ভিটামিন সি
- শীর্ষে দিল্লি,২ নাম্বারে ঢাকা