সাম্প্রতিক সংগীতের ‘যুবরাজ’ বলে ডাকা হয় তাকে। সেই আসিফ আকবর গ্রেফতার হয়েছেন ৫৭ ধারার মামলায়। শফিক তুহিন নামে একজন মামলাটি করেছেন। আমার অজ্ঞতা যে, আসিফ আকবর গ্রেফতার হবার আগ পর্যন্ত এই ভদ্রলোকের নামটি আমার খুব করে জানা ছিল না।

সাহিত্য-সংস্কৃতির জগৎটিকে সাধারণত ক্রিয়েটিভ মানুষদের জগৎ বলা হয়। এখানে সবাই সৃষ্টির নেশায় মত্ত থাকেন, ধ্বংসের নয়। শিল্পবোধের একটি অংশ হলো ‘জেলাসি’ বা ঈর্ষা। অন্য ক্ষেত্রে ঈর্ষা বিষয়টি বিপত্তি তথা ধ্বংস ঘটালেও শিল্প-সংস্কৃতির জগতে বিষয়টি ছিল বিপরীত। ‘ঈর্ষা’ এখানে প্রতিহিংসা নয়, সৃষ্টি করত প্রতিযোগিতার।

‘ঈর্ষা’ ছিল সৃষ্টির অন্যতম প্রেষণা। সম্প্রতি এ জগতটির মন-মানসেও পরিবর্তন ঘটছে। সেই প্রেষণা আজ প্রতিহিংসায় প্রতিস্থাপিত হয়ে পরিণত হয়েছে ধ্বংসের প্রণোদনায়।

ক’দিন আগেও দেখলাম ‘স্ক্রিনশট’ বিষয়ক ক্যাচাল। মামলা, পাল্টা মামলা, সেই ৫৭-ধারার অযাচিত আস্ফালন। এমন পাল্টাপাল্টির শেষটা হলো আপোষে। আরও কয়েকটি ঘটনা রয়েছে এ রকম। অবশ্য মামলা বা ঘটনার শেষ হলেও শিল্প-সংস্কৃতি জগতের সৌন্দর্য শেষের শুরুটা করে দিয়েছে এমন কীর্তিগুলো।

১.আসিফ আকবরের বিরুদ্ধে যে অন্যায়ের অভিযোগ, তাতে তো ৫৭ ধারায় মামলা হবার কথা নয়। সত্যিই যদি আসিফ আকবর অন্যের স্বাক্ষর জালিয়াতি করেন কিংবা প্রতারণার মাধ্যমে অন্যের গান বেঁচে দেন, তবে তো অনেক আগেই তার বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলা হবার কথা। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণে মামলা না হয়ে, সামাজিক মাধ্যমের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মামলা হলো তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বহুল আলোচিত ৫৭ ধারায়, প্রশ্নটা এখানেই।

ধরে নিলাম আসিফ আকবর দোষী, কিন্তু মামলার এই প্যাটার্নটা কি সেই দোষের দায়মুক্তির কারণ হলো না? একজন লেখকের কাছে তার সৃষ্টি সন্তানের মতো। সুরকার ও গায়কের কাছেও তাই। সেই সন্তানকেই যখন চুরি করা হলো, তখন হৃদয়ে বাঁধল না! কথায় বলে, ‘অর্থই সব অনর্থের মূল’। সেই অর্থই যখন বেহাত হলো জালিয়াতির মাধ্যমে, তখনো আইনের আশ্রয় নেওয়া গেল না! আইনের আশ্রয় নিতে হলো, ফেসবুকের কথায়!

এখানে দুটি বিষয় এসে যায়- এক হলো, আসিফ আকবরের বিরুদ্ধে অভিযোগটি জেনুইন নয়, যাতে সে সাজা পাবে। দ্বিতীয়টি হলো, প্রতিহিংসা। জায়গা মতো পেয়ে তাকে দেখে নেওয়া। আবারও বলছি, আসিফ আকবর যদি দোষীও হয়, ৫৭-ধারার মামলাটি সেই দোষকে পেছনে ফেলে অভিযোগকারীর সম্ভাব্য প্রতিহিংসার বিষয়টিই সামনে এনেছে। একটা বিতর্কিত ধারা, যা নিয়ে সরকারও বিব্রত, সেই ধারাটিকে ব্যবহার করায় শিল্প-সংস্কৃতির মান কতটা উন্নীত হয়েছে, তা ভেবে দেখার বিষয় এ জগতের সাথে সংশ্লিষ্টদের।

২. ‘ক্যানিবালিজম’ শব্দটি বারবার ব্যবহার করতে হচ্ছে। একটি সমাজ যখন প্রতিহিংসায় আক্রান্ত হয়, অন্যের কষ্টে খুশি হয়, মৃত্যুতে উৎসব করে; তখন এ শব্দটি ব্যবহার করা ছাড়া কোনো উপায়ও থাকে না। আদিম অ্যামাজনের প্রাচীন সমাজে ‘ক্যানিবালিজম’ ছিল প্রকাশ্যে। অবশ্য এখনকার ‘ক্যানিবাল’রা ‘ছুপা রুস্তম’। এনারা মানবতার নামে ‘মাদার তেরেসা’র গলায় মালা চড়ান, আবার মানুষের গলা কাটায় মচ্ছব করেন। অথচ সেই মালার আড়ালে গলা কাটার ছুরিটা যে ক্রমে তাদের দিকেই ধাবমান- মচ্ছবে মোহগ্রস্তরা তা বিস্মৃত হন।

আর এই বিস্মৃতিই ঘটায় বিপত্তি। শেষ গলাটা যখন কাটা পড়ে, তখন আনন্দ করারও কেউ থাকে না, থাকে না শোক ও প্রতিবাদের মানুষও।

সে জন্যেই মার্টিন নিম্যোলার লিখেছিলেন- First they came for the Socialists and I did not speak out-Because I was not a Socialist.

এবং শেষে লিখলেন- Then they came for me- and there was no one left to speak for me.